পরামর্শ
ডা.এবিএম আবদুল্লাহ’র
নিউজ অফ পাইকগাছা ॥
ইসলামের ৫ টি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। রমজানের রোজা আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। এর মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা রেখেছেন অফুরন্ত রহমত, বরকত, মাগফিরাত, নাজাত ও ফযিলত। রমজানের রোজা রোজাদারের জন্য ঢাল স্বরূপ। রোজা আল্লাহ তায়ালার জন্য এবং আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান দিবেন। তাই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান শত বাধা বিপত্তির মাঝেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এর মাধ্যমেই তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান। অনেকে জটিল রোগে ভোগেন, কিন্তু নিজের আত্মার শান্তি এবং ধর্মীয় নির্দেশনার প্রয়োজনে রমজানের রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আবার এমনও লোক দেখা যায় যারা অজুহাত খোঁজেন রোজা না রাখার, নিজের মত করে খোঁজেন ধর্মীয় নির্দেশনা। এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেম ওলামা বা ইসলামী চিন্তাবিদরা সম্পূর্ণ একমত যে, অনেক নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে আক্রান্ত যে কেউ রোজা রাখতে পারবেন। এমনকি অনেক রোগের ক্ষেত্রে রোজা রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তীব্র অসুস্থতায় অথবা কোন জটিল রোগে রোজা রাখা না রাখার ব্যাপারেও ধর্মীয় নির্দেশনা আছে। প্রয়োজনে পরে কাযা করার বিধানও সুস্পষ্টভাবে দেয়া আছে। কোন অজুহাতে বা সামান্য কোন অসুস্থতায় রোজা না রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই।
>>>> পেপটিক আলসার রোগে আক্রান্ত রোগী
যারা গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পেপটিক আলসারে ভোগেন, তারা অনেকেই মনে করেন খালি পেটে থাকলে এসিডিটির সমস্যা বাড়বে। এ ধরনের রোগীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন যে রোজা রাখবেন কি না। আসলে রোজা রাখলে সাধারণত এসিডিটি বাড়ে না। রোগীদের প্রধান কাজ হলো নিয়মিত খাবার খাওয়া, নিয়মিত ঘুমানো এবং নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ। রোজায় মানুষের জীবন একটা নিয়মে চলে আসে বিধায় এ সময় এসিডিটির সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়। অবশ্যই ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে ইফতার এবং সেহেরির সময় রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধ একটা করে খেয়ে নিতে পারেন। এমনকি রাত্রে দুই তিনবার এন্টাসিড ওষুধ খেলেও কোন অসুবিধা হবে না।
>>>> ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস হলে রোগী রোজা রাখতে পারবেন না একথা মোটেই ঠিক নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকগণ এবং ইসলামী আলেমগণ উভয়েই রোজা রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সহজেই রোজা রাখা সম্ভব। আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য রোজা রাখা অনেক সহজ করে দিয়েছে। তবে রোজা রাখার জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন কিংবা কোনো ওষুধ গ্রহণের সময়টা একটু পরিবর্তন করে সেহরি ও ইফতারের সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে হবে। এ ব্যাপারে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ কিংবা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই কিছু ঝুঁকি থাকে। যেসব ডায়াবেটিক রোগী ঝুঁকির কথা জেনেও ধর্মীয় কারণে রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তারা রোজা শুরুর আগেই চিকিত্সকের সাথে পরামর্শ করে জটিলতা এড়িয়েই রোজা রাখতে পারেন।
>>>> হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগী
আমাদের দেশে অনেক হাঁপানি রোগী আছেন। তাদের কেউ কেউ রোজা না রাখার কারণ হিসেবে হাঁপানির কথা বলে থাকেন। রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের রোজা রাখতে কোনো বাধা নেই। রোজা কোনোভাবেই হাঁপানি রোগ বাড়িয়ে দেয় না। বরং বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে রোজা হাঁপানি রোগীকে কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। যদি হাঁপানি বাড়তেই থাকে, তাহলে রোগী ইফতার এবং সেহেরির সময় দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় বড়ি খেয়ে নিতে পারেন। এতে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের বেলায় শ্বাসকষ্ট হলে ইনহেলার নেয়া যাবে। তাতে রোজার কোন ক্ষতি হবে না।
>>>> কিডনি রোগ
যারা কিডনির রোগে আক্রান্ত তাদের রোজা রাখা যাবে না এমন কোনো কথা নেই। যে সমস্ত রোগী ক্রনিক কিডনি ফেইলুরে আক্রান্ত, তাদেরকে সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে হয়, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, এমনকি পানি খাওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা ও পরিমাণ অনুযায়ী খেতে হয়। তাই রোজা রাখার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যাদের কিডনি ফেইলুরের মাত্রা একেবারে শেষ পর্যায়ে, তাদের পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব নয়। তেমনি যারা ডায়ালাইসিসের রোগী অথবা ইতোমধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন তাদের পক্ষেও রোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। অল্প থেকে মধ্যম মাত্রার কিডনি ফেইলুর রোগীরা রোজা রাখলে কোনো ক্ষতি হয় না। তবে কিডনি আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, সর্বাবস্থায় একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়াই শ্রেয়।
>>>> উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বেলায় রোজা আরও উপকারি। আজকাল অনেক ওষুধ পাওয়া যায় যেগুলো দিনে একবার বা দুইবার খেলেই চলে। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী ইফতার বা সেহেরির সময় বা প্রয়োজনে দুইবারই ওষুধ খেলে রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অনেক রোগীর রক্তে কোলেস্টেরল বা অন্যান্য চর্বির মাত্রা বেশি থাকে। এসব নিয়ন্ত্রণেও রোজা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রোজা রাখার মাধ্যমে রোগীদের কোলেস্টেরল মাত্রা প্রায় ১০-২০ শতাংশ কমে যায়। একই সঙ্গে তাদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতাও কমে যায়।
>>>> হার্টের রোগ
হূদরোগ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই রোজা রাখতে কোন নিষেধ নেই। তবে একিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, হার্ট ফেইলুর ইত্যাদি রোগ থাকলে রোজা না রাখাই শ্রেয়। আবার একথাও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে হূদরোগীদের জন্য রোজা রাখা খুবই উপকারি। ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলা, চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা এবং ইফতারের দুই ঘণ্টা পর একটু ব্যায়াম করা উচিত। যারা নিয়মিত তারাবির নামাজ আদায় করেন, তারা ব্যায়াম নাও করতে পারেন। যারা নিয়মিত ওষুধ খান, তারা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সম্ভব হলে সবগুলো ওষুধ রাত্রের বিভিন্ন সময়ে ভাগ ভাগ করে খেলে যদি অসুবিধা না হয় তো সেভাবেই ওষুধ খাবেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দিনে যদি এনজাইনার ব্যথা হয়, তবে জিহ্বার নিচে স্প্রে জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে, তাতে রোজার ক্ষতি হবে না।
>>>> লিভারের অসুখ
লিভারের রোগীদের রোজা রাখা নির্ভর করে রোগটির ধরনের উপর। কেউ যদি ভাইরাল হেপাটাইটিস নামক রোগে আক্রান্ত হন, তারা খেতে পারেন না, ঘন ঘন বমি হয়, রুচি নষ্ট হয়, জন্ডিস দেখা দেয়। অনেক সময় তাদের শিরায় স্যালাইন বা গ্লুকোজ দিতে হয়। তাদের পক্ষে রোজা না রাখাই ভালো। আবার যারা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত, তাদের যদি রোগের লক্ষণ কম থাকে, তবে রোজা রাখতে পারেন। খারাপ লাগলে রোজা ভেঙ্গে ফেলবেন। কোন কোন সময় সিরোসিস রোগীদের পেটে বা পায়ে পানি জমতে পারে, শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তাদের বেলায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। রোজা না রেখে কাফফারা দিতে হবে বা বদলি রোজা অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হবে। প্রয়োজনে আলেম ওলামাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
>>>> চোখ, কান বা নাকের রোগী
রোজায় চোখের বা নাকের রোগীরা যে সমস্যায় পড়েন সেটি হল রোজা রাখা অবস্থায় ড্রপ ব্যবহার করতে পারবেন কি না। চোখ বা নাকে ড্রপ দিলে তা মুখে চলে যেতে পারে, তা ফেলে দিয়ে কুলি করে ফেলা উচিত। ফলে ওষুধ গলায় বা পেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সে ক্ষেত্রে রোজা রেখে অনায়াসে চোখে বা নাকে ড্রপ দেয়া যায়। কানের ড্রপ দিলেও রোজার কোন ক্ষতি হবে না। এমন মতামতই ব্যক্ত করেছেন ইসলামি চিন্তাবিদগণ।
>>>> গর্ভাবস্থায় রোজা
গর্ভবতী মায়ের যদি শারীরিক কোনো জটিলতা না থাকে, তা হলে রোজা থাকতে কোনো বাধা নেই। বিশেষ করে প্রথম কয়েক মাস সহজেই রোজা রাখা যায়। রোজা রাখবেন কি রাখবেন না, তার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করা উচিত। রোজা রাখলে যদি মা বা বাচ্চার কারো ক্ষতি হয়, বা এ ব্যাপারে যদি ডাক্তারের কোন নিষেধাজ্ঞা থাকে, তবে রোজা না রাখাই ভালো।
>>>>বুকের দুধ খাওয়ানো
বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। রোজা রাখলে বুকের দুধ কমে যায় না। অবশ্যই সেহরি ও ইফতারের সময় প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। ইফতারের পর শোয়া পর্যন্ত প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে।
মানুষের রোগের শেষ নেই, ধরনও এক নয়। সব রোগ নিয়ে আলোচনাও সম্ভব নয়। তাই যে কোন রোগী, যারা রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অথচ দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগেন, তাদের উচিত ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন ডাক্তার বা আলেম ওলামার সাথে পরামর্শ করে রোজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন।
রোজা একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ধর্মীয় দিক থেকে যেমন এর ফযিলত অসীম তেমনি স্বাস্থ্যগত দিক চিন্তা করলেও এর উপকার অনেক। একমাসের সিয়াম সাধনা আমাদের দেহ ও মন উভয়কেই পরিশুদ্ধ করে। তাই আলস্য করে, ছোট খাট রোগের অজুহাত খাড়া করে একে পালন না করা মোটেই উচিত নয়।
শেষ কথা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে কিংবা সামান্য অসুস্থতায় রোজা রাখতে কোনো নিষেধ নেই, বরং রোজা রাখা রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে তীব্র অসুস্থতায় কিংবা জটিল রোগে রোজা রাখা ঠিক হবে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক।
>>>>>> >>>>>>>>>>>>>>>>>>ডা. এবিএম আবদুল্লাহ’র পরামর্শ<<<<<<<<<<<<<<<<<<<<<<<<<