বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘জীবনে আর কোন দিন মা আমাকে আর ডাকবে না। আমার কোলেই মায়ের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের অনেককে মাকে বাঁচানোর জন্য পা ধরেছিলাম। কেউ গুরুত্ব দেইনি। মৃত্যুর আগে মা আমাকে তিন বার ডেকেছিল। আমি মাকে বলেছিলাম মা আমার কিছু হয়নি। তোমারও কিছু হবে না। তুমি ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু হাসপাতালের কেউ আমার আকুতি শোনেনি। ধীরে ধীরে আমার কোলেই মায়ের মৃত্যু হয় এবং আমাকে ছেড়ে মা চিরদিনের জন্য চলে যায়। জীবনে এক সঙ্গে এত লাশ এর আগে কখনও দেখিনি। আর কখনও মা ফিরে আসবে না। আমাকে মা বলে আর কেউ ডাকবে না।’ কান্না এবং হাহাজারীর মাঝে শোকে বিভোর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হালিমার মেয়ে তাসলিমা (১৭) তার মাকে নিয়ে এভাবেই আহাজারী করছে। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলেও মা এবং পরিবারের ৫ সদস্যের মৃত্যু শোকে বিভোর হয়ে পড়েছে তাসলিমা। তাসলিমা মায়ের লাশের সাথে বৃহস্পতিবার বিকালে ফিরে আসে উল্লেখ্য, গত বুধবার বিকালে বাগেরহাটের ষাট গুম্বুজ মসজিদ থেকে মানত সম্পন্ন শেষে মিনি পিকআপযোগে বাড়ি ফেরার পথে বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের কাটাখালী নামকস্থানে পিছন দিক থেকে দ্রুতগামী যাত্রীবাহী পরিবহন ধাক্কা দিলে পিকআপটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মর্মান্তিক এ সড়ক দুর্ঘটনায় পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী ইউনিয়নের গজালিয়া ও লক্ষ্মীখোলা গ্রামের একই পরিবারের ৫ জন সহ ৬ ব্যক্তি নিহত হয়। নিহতরা হলেন, লক্ষ্মীখোলা গ্রামের আব্দুল মান্নান গাজীর স্ত্রী হালিমা বেগম, বোন আলেয়া বেগম, বোন জামাই আব্দুল সানা, ভাগ্নে বিলকিস বেগম, ভাগ্নে জামাই শহিদুল ইসলাম ও প্রতিবেশী লুৎফর রহমান। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় আহত হয় কমপক্ষে নারী ও শিশুসহ ১৫ ব্যক্তি। বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন নিহত বিলকিসের বড় ছেলে বাপ্পী (১৮), মেয়ে পপি (১৭), ছোট ছেলে সাব্বির (৮ মাস), বিলকিসের ভাই আরিফুলের স্ত্রী আছিয়া বেগম (৩০), ছেলে জাকারিয়া (৪), বিলকিসের বোন পুতুল (২৮), পুতুলের ছেলে রাকিব (১৩), মেয়ে বৃষ্টি (৬) ও শ্বাশুড়ি এবং নিহত লুৎফর রহমানের স্ত্রী ও পুত্র বধু। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা এখনও আশংকামুক্ত নয় বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছন। এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত ঘাতক পরিবহনটিকে চিহ্নিত কিংবা জব্দ করতে পারেনি। আহতদের চিকিৎসার সাহায্যার্থে সরকারী সহায়তা সহ ঘাতক পরিবহনটি জব্দ করে আইনের আওতায় আনার দাবী জানিয়েছে নিহতদের স্বজনরা। দুর্ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি তাসলিমাসহ নিহত ৬ জনের স্বজনরা। এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ষষ্ঠ শ্রেণী পড়–য়া স্কুল ছাত্রী খাদিজা। দুর্ঘটনা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না সে। পিকআপটি দুর্ঘটনায় কবলিত হওয়ার সাথে সাথেই অচেতন হয়ে পড়ে খাদিজা। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে আসলেও স্বজনদের মৃত্যু শোকে বিভোর রয়েছে খাদিজা। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করছে পরিবারের কারোর সাথে কোন কথা বলছে না। নিথর একটি মানুষের ন্যায় বাড়ির বারান্দায় পড়ে রয়েছে খাদিজা। নিহতদের স্বজনদের ন্যায় শোকাহত এলাকার মানুষ। মৃত্যু শোকে গোটা এলাকা যেন নিস্তব্দ হয়ে পড়েছে। এখনও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছে নিহতদের বাড়িতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন